বুধবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০১৩

তারেক রহমান

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তম এবং তিনবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জেষ্ঠ্য সন্তান তারেক রহমানের জন্ম ১৯৬৫ সালের ২০ নভেম্বর তারিখে। তিনি দেশের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ হতে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হন ও পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৮৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করার পর তিনি পেশা হিসেবে ব্যবসায়কে বেছে নেন। ব্যবসায়ে অবতীর্ণ হয়ে তারেক রহমান বস্ত্রশিল্পে বিনিয়োগ করেন ও স্বল্প সময়ের মাঝে ঐ ব্যবসায়ে সাফল্য অর্জন করেন। পরে তিনি নৌ-যোগাযোগ খাতেও বিনিয়োগ করেন ও সাফল্য অর্জন করেন।

রাজনীতি


বাবা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের বগুড়া কমিটির সদস্য হিসেবে যোগদান করে তারেক রহমান তার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা করেন। আনুষ্ঠানিক ভাবে সংগঠনের যোগ দেয়ার পূর্বেই তারেক রাজনীতিতে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তারেক তার মায়ের সহচর হিসেবে সারা দেশের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন। ২০০১ সালের নির্বাচনেও তারেক রহমান মা বেগম জিয়ার প্রচারণা কার্যক্রমের পাশাপাশি পৃথক পরিকল্পনায় দেশব্যাপী নির্বাচনী প্রচারণা চালান। মূলত ২০০১ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় তার অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাজনীতির প্রথম সারিতে তারেক রহমানের সক্রিয় আগমন ঘটে ।

২০০২ সালের পর গণ-সংযোগ

২০০২ সালে তারেক রহমান দলের স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপির একজন জেষ্ঠ্য যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে দায়িত্মপ্রাপ্ত হন। দলের উর্দ্ধতন পর্যায়ে নিয়োগ লাভের পরপরই তারেক রহমান দেশব্যাপী দলের মাঠপর্যায়ের নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের সাথে ব্যাপক গণসংযোগ শুরু করেন। মূল সংগঠন সহ সহযোগী সংগঠন যেমন জাতীয়তাবাদী যুব দল, জাতীয়তাবাদী ছাত্র দল, জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল ইত্যাদি আয়োজিত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মতবিনিময় সভায় অংশ নিয়ে তারেক রহমান কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন ও মাঠপর্যায়ের নেতৃবৃন্দের বক্তব্য ও মতামত গ্রহণ করেন। এ সভাগুলোতে তারেক মূলত দলের গঠনতন্ত্র, উদ্দেশ্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে নেতাকর্মীদের সাথে দীর্ঘ মতবিনিময় করেন। বিস্তারিত মতবিনিময়ের বিষয়বস্তুর মাঝে আরও ছিল প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের আদর্শ বাস্তবায়নে দলের করণীয় ও দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন- অগ্রগতি নিশ্চিতকরণে সরকারী দল হিসেবে বিএনপির করণীয় প্রসঙ্গে আলোচনা। পরবর্তীতে দেখা যায় যে এই জনসংযোগ কার্যক্রমের ফলে দলের নেতাকর্মীদের তরুণ অংশটির মনোবল অসামান্য বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে তারেক রহমান শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধানমন্ত্রীর সন্তানের পরিচিত থেকে বেরিয়ে এসে দলের একজন দক্ষ সংগঠক ও সক্রিয় নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

সেনা সমর্থিত সরকার কর্তৃক গ্রেপ্তার

১১ জানুয়ারী, ২০০৭ তারিখে নিয়মতান্ত্রিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অপসারণ করে বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর তৎকালীন চিফ অফ স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল (পরে জেনারেল হিসেবে অবসর নেন) মঈন উদ্দীন আহমেদের হস্তক্ষেপে একটি অগণতান্ত্রিক ও অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়। ১২ জানুয়ারী উপদেষ্টা পরিষদ নাম্নী একটি মন্ত্রীসভা গঠিত হওয়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে দেশের শীর্ষ রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দূর্নীতির অভিযোগ প্রচুর মামলা দায়ের করা হয়।
৭ মার্চ, ২০০৭ তারিখে একটি দূর্নীতি মামলার আসামী হিসেবে তারেক রহমানকে তার ঢাকা ক্যান্টমেন্টস্থ মইনুল রোডের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে আরও ১৩টি দূর্নীতির মামলা দায়ের করা হয় ও তাকে বিচারের সম্মুখীন করা হয়।

আটকাবস্থায় শারীরিক নির্যাতন

গ্রেপ্তারের কিছুদিন পর তারেককে আদালতে হাজির করা হলে তার শারীরিক অবস্থার প্রচন্ড অবনতি সবার নজরে পড়ে। তার আইনজীবিরা আদালতে অভিযোগ করেন যে জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে তারেক রহমানের উপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। আদালতের নির্দেশে চিকিৎসকদের একটি দল পরীক্ষা-নীরিক্ষার পর আদালতকে জানায় যে তারেক রহমানের উপর শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ যুক্তিযুক্ত।
প্রথমে আইনজীবিরা আদালতে আবেদন জানান যেন তারেক রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদের উদ্দেশ্যে রিমান্ডে পাঠানো না হয়। আদালত সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু পরে দেখা যায় রিমান্ডের পর তারেক রহমানের শারীরিক অবস্থার ক্রমান্বয়ে অবনতি হচ্ছে। এক পর্যায়ে তারেক রহমান আর নিজের পায়ে হেঁটে আদালতে আসতে পারতেননা; তাকে প্রিজন ভ্যানের পরিবর্তে অ্যাম্বুল্যান্সে করে আনা প্রয়োজন হত ও তিনি এজলাসে উপস্থিত হতেন স্ট্রেচারে করে। এই পর্যায়ে আদালত রিমান্ডে নেয়ার আদেশ শিথিল করে তা কমিয়ে ১ দিন ধার্য করেন ও জিজ্ঞাসাবাদকারীদের সাবধানতা অবলম্বনের আদেশ দেন।
অবস্থার অবনতি অব্যাহত থাকলে তারেক রহমানকে কেন্দ্রীয় কারাগারের পরিবর্তে ঢাকার শাহবাগস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
২৫ আগস্ট, ২০০৭ তারিখে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে তারেক রহমান তার হাসপাতাল কক্ষে পা পিছলে পড়ে গিয়ে আহত হয়েছেন। এরপর খবরের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয় ও ধারণা সৃষ্টি হয় যে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতনকে গোপন করার লক্ষ্যে এই খবর ছড়ানো হয়েছে। এতে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ দেখা দেয়, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ ও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।

মুক্তিলাভ

২০০৮ এর আগস্টে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলাগুলো আদালতে গতি লাভ করে। প্রায় আঠারো মাস ব্যাপী নিপীড়িত অবস্থায় কারান্তরীণ থাকার পর ৩ সেপ্টেম্বর, ২০০৮ তারিখে সবগুলো মামলায় তারেক রহমানের জামিনলাভ সম্পন্ন হয় ও তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মুক্তি লাভ করেন।
তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দূর্নীতির অভিযোগগুলো এই মুহুর্তে জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়ে আছে। একটি নির্দিষ্ট সময়ে সীমাহীন দূর্নীতির অভিযোগ আনা হলেও পরবর্তীতে দীর্ঘ সময় যাবৎ আইনী লড়াই চালিয়েও কোন কর্তৃপক্ষ আদালতের কাছে দূর্নীতির প্রমাণ উপস্থাপন করতে না পারায় কোন কোন রাজনৈতিক বিশ্লেষক সন্দেহ পোষণ করেছেন তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দূর্নীতির অভিযোগ অনেকাংশেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল কিনা। 

চিকিৎসা ও বিদেশে অবস্থান

১১ সেপ্টেম্বর, ২০০৮ তারিখে বিশেষ কারাগার থেকে বেগম খালেদা জিয়া মুক্তি পাওয়ার পর তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পুত্র তারেক রহমানকে দেখতে যেন। সেদিন রাতেই তারেক রহমান উন্নত চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যের উদ্দেশ্যে রওনা হন। বর্তমানে লন্ডনের সাউথ ওয়েলিংটন হসপিটাল ও লন্ডন হসপিটালে তার চিকিৎসা চলছে এবং চিকিৎসার সুবিধার্থে তিনি সেন্ট্রাল লন্ডনের এডমন্টনে সপরিবারে বসবাস করছেন।
তারেক রহমানের বিরুদ্ধে আনীত দূর্নীতির অভিযোগের কোনটিরই কোন প্রমাণাদি এখন পর্যন্ত আদালতে উপস্থাপিত হয়নি। বিরোধী দলীয় নেত্রী থাকাকালীন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তারেক রহমান সহ তার কার্য্যালয়ের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করেছিলেন সেগুলোও এখনও অপ্রমাণিত ও অমীমাংসিত অবস্থায় রয়ে গিয়েছে। উপরন্তু সরকার পক্ষ হতে দায়ের করা একটি দূর্নীতি মামলা কেন বাতিল করা হবেনা এই মর্মে দেশের উচ্চ আদালত সরকারকে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দিয়েছেন।

বিএনপির পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিল

৮ ডিসেম্বর, ২০০৯ তারিখে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিএনপির পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে তারেক রহমান সংগঠনের জেষ্ঠ্য ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
উক্ত কাউন্সিলে তারেক রহমানের একটি ধারণকৃত বক্তব্য উপস্থিত জনসমাবেশের উদ্দেশ্যে প্রচার করা হয়। বক্তব্যটিতে তারেক রহমান জানুয়ারী ২০০৭-এ ক্ষমতায় আসা অগণতান্ত্রিক সরকারের হাতে তার অন্যায় গ্রেপ্তার ও বন্দী অবস্থায় নির্যাতনের বর্ণনা দেন। তিনি নিশ্চিত করেন যে আপাতদৃষ্টিতে মনে হওয়া বিচার বিভাগীয় ব্যাবস্থার আড়ালে তাকে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। তারেক রহমান তার শারীরিক অবস্থার বর্ণনা দেন ও জানান তার চিকিৎসা সম্পন্ন হতে আরও সময় প্রয়োজন। এই বক্তব্য প্রচারিত হওয়ার সময় উপস্থিতদের কেউ কেউ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।
উক্ত কাউন্সিলে আরও বক্তব্য রেখেছেন ব্রিটিশ সংসদ সদস্য জর্জ গ্যালোওয়ে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রচারমাধ্যম বিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল প্রমূখ।


তারেক রহমান সম্পর্কে আবদুল হাই শিকদারের একটি লিখা নিচে দেয়া হল


যিশুখ্রিস্টের জন্মের ৩৯৯ বছর আগে এথেন্সে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মহামনীষী সক্রেটিস বিচারকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আমি অপরাপর লোকের মতো সাধারণ নির্ঝঞ্ঝাট জীবন কাটাইনি। আমি আমার নীতির দৃঢ়তা নিয়ে বেঁচেছিলাম। যে জীবনে আমি নিজের বা অপরের মঙ্গল সাধন করতে পারব না তা গ্রহণ করিনি। আপনাদের সব সময়ই এ কথা বোঝাতে চেয়েছি, ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে নিজের আত্মার উন্নয়নের দিকে দৃষ্টি দেয়াই শ্রেয়। এরূপ জ্ঞানদানের পরও আজ আমি কী পাচ্ছি? এই কি আমার প্রাপ্য ছিল? ... আমাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে আপনারা ক্ষণস্থায়ী খ্যাতি হয়তো পাবেন, কিন্তু কিছুদিন পরই জ্ঞানী সক্রেটিসকে হত্যার দায়ে আজকের নিন্দুকরা আপনাদেরই দোষারোপ করবে। ... তোমরা যদি ভাব তোমাদের পাপকাজের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠকে হত্যার মাধ্যমে রুদ্ধ করতে পারবে, তাহলে তা ভুল ধারণা। কারণ অব্যাহতি লাভের এই উপায় সম্ভবত বিশ্বাসযোগ্যও নয়। শ্রেষ্ঠ ও সহজতম উপায় হচ্ছে কাউকে দমিয়ে রাখা নয়, বরং নিজেকে উন্নত মানুষরূপে গড়ে তোলা।’
সক্রেটিসের এই অমোঘবাণী উচ্চারণের ২৩৩৪ বছর পর প্রকাশিত শচীন সেনগুপ্তের ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে দেশি-বিদেশি চক্রান্তে অসহায় বন্দি শেষ নবাব প্রায় কাছাকাছির ভাষায় বলেছেন, ‘বাংলার প্রজাকুল যাতে সর্বহারা না হয়, তোমাদের সুখের সংসার যাতে ভাস্কর পণ্ডিতের রোষানলে ভস্মীভূত না হয়, তোমাদের সন্তান-সন্ততিরা যাতে না পতঙ্গের মতো প্রাণবলি দিতে বাধ্য হয়, তারই জন্য বিশ্বাস করো ভাইসব, শুধু তারই জন্য যৌবনের দুর্বার আকর্ষণ উপেক্ষা করে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার পথে-প্রান্তরে সংগ্রামস্থলে উল্কার মতো ছুটে বেড়িয়েছি। তারই পুরস্কার কি ওই কণ্ঠক আসন? তারই পুরস্কার কি ছিল পাদুকা? তারই পুরস্কার কি এই তস্করলব্ধ লাঞ্ছনা?’

জ্ঞানী সক্রেটিস কিংবা শহীদ সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে অন্য কারও তুলনা বা প্রতিতুলনা নয়। অভিযোগ দায়ের করার পদ্ধতি ও সাযুজ্য দেখলে অনেক ধরনের মিল খুঁজে বের করতে পারবেন যে কেউ। সত্য প্রচারে অকুতোভয় ছিলেন সক্রেটিস। তাই তার বিরুদ্ধে দায়ের করা এক ঝুড়ি মিথ্যা অভিযোগ : সক্রেটিস নাস্তিক, তিনি এথেন্সের দেবদেবীদের স্বীকার করেন না। তিনি কল্পিত নতুন দেবদেবী প্রতিষ্ঠা করতে চান। তরুণদের তিনি নৈতিকভাবে বিপথগামী করেছেন।

আর সিরাজউদ্দৌলার অপরাধ ছিল তিনি চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার জন্য রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। এ জন্য যেমন তাকে প্রাণ দিতে হয়, তেমনি তার বিরুদ্ধে রচিত হয় ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা অভিযোগ। তিনি অত্যাচারী, তিনি ইন্দ্রিয়াসক্ত, তিনি নারীলোলুপ। আরও কত কী? সক্রেটিসের বিরুদ্ধে অভিযোগকারীরা ছিলেন সেই সময়কার এথেন্সের ফালতু ও সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়। আর সিরাজের বিরোধিতায় সবাই ছিলেন মাতৃভূমির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী।

দুই.
বাংলাদেশকে ব্যর্থ ও অকার্যকর করার প্রবক্তারা সেদিনের মতো শিখণ্ডী হিসেবে দাঁড় করায় মীর জাফরের মতো মইন উকে। পরে মইন উর দায়িত্ব হস্তান্তরিত হয় হাসিনার হাতে। যেভাবে মীর জাফরের কাছ থেকে ক্ষমতা চলে যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে। এরা তাদের উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার পথে বড় বাধা হিসেবে দেখতে পায় তিনটি জিনিস। এক. বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, শহীদ জিয়ার রাজনৈতিক দর্শন ও তার ইমেজ, দুই. জিয়া পরিবার, তিন. জাতীয়তাবাদী দর্শনের চর্চাকারী দল বিএনপিকে। বাংলাদেশকে আধিপত্যবাদের কাছ থেকে রক্ষা করার এই তিন স্তম্ভকে ধ্বংসের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে ওই চক্র এবং অনুধাবন করে বেগম খালেদা জিয়ার পর জাতীয়তাবাদী শক্তির ভবিষ্যত্ কাণ্ডারি মাত্র একজন। তিনি তারেক রহমান। তারেক রহমানকে অক্ষত রেখে তাদের উচ্চাভিলাষ সফল করা সম্ভব নয়। তারা এও অনুধাবন করে, তারেক রহমান বাংলাদেশের তারুণ্যের প্রতীক। এই প্রতীক অপসারণ করা না গেলে বাংলাদেশের ভবিষ্যেকও শূন্য করা সম্ভব হবে না। তারেক রহমান আধিপত্যবাদের বিরোধিতার পথে যেতে বাধ্য, তারেক রহমান বাংলাদেশের তারুণ্যকে সংগঠিত করেছিলেন, তিনি তার মহান বাবার মতোই ষড়যন্ত্রের অতীতমুখী রাজনীতি উচ্ছেদ করে ভবিষ্যত্মুখী, উন্নয়নের রাজনীতিকে সামনে এগিয়ে এনেছিলেন। তিনি একটি বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। আর এই কাজগুলো যদি করতে পারতেন নির্বিঘ্নে, তাহলে এশিয়ার ইমার্জিং টাইগার বাংলাদেশকে পঙ্গু করে রাখা সত্যিকার অর্থেই মুশকিল হতো শত্রুদের। আর কে না জানে যে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বলে বগল বাজায় বর্তমান শাসকরা, আসলে তারও স্থপতি ছিলেন তারেক রহমান।

তারেক রহমান বিএনপিকে যুগোপযোগী করার ক্ষেত্রেও গ্রহণ করেছিলেন কিছু পদপক্ষেপ, যা তৃণমূল পর্যন্ত আলোড়ন তুলেছিল। আর প্রতিপক্ষ হয়ে পড়েছিল কোণঠাসা। মোট কথা তারা পড়েছিল অস্তিত্বের সঙ্কটে। ফলে মরিয়া হয়ে ওঠে বাংলাদেশের শত্রুরা। তারা তাদের ষড়যন্ত্রের প্রধান টার্গেট হিসেবে চিহ্নিত করে তারেক রহমানকে। তারা তাদের অনুগ্রহভাজন মিডিয়ার ঘাড়ে সওয়ার হয়ে সব ধরনের হিংসা ও হিংস্রতাকে একত্রিত করে অপপ্রচারের এক ঝড় বইয়ে দেয় দেশজুড়ে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেই মিডিয়া যেগুলোকে শেখ মুজিব পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কবরে, আর নতুনভাবে তাদের উদ্ধার করে মুক্তি এনে দিয়েছিলেন তারেক রহমানের বাবা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।
ইংরেজি প্রবাদের ‘কুকুরটিকে একটি খারাপ নাম দাও’ এর মতো আধিপত্যবাদের নীল নকশাা অনুযায়ী সবকিছু গুছিয়ে আনার পর জাতির ঘাড়ের ওপর হামলে পড়ে মইন উ ও ফখরুদ্দীনের ১/১১। তাদের হাতে বয়েত গ্রহণ করে আসে শেখ হাসিনার বাংলাদেশবিমুখ সরকার। এরা সম্মিলিতভাবে তারেক রহমানের ওপর একে একে চাপিয়ে দেয় জঘন্য অপবাদ সমৃদ্ধ মিথ্যা মামলার বহর। একে একে ১৩টি মামলা। ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার জনসমাবেশে গ্রেনেড হামলা তার একটি।

তিন.
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিষয়টি বাংলাদেশের সমকালীন রাজনীতির ইতিহাসে খুবই আলোচিত একটি ঘটনা। তারেক রহমানসহ বিএনপির শীর্ষস্থানীয় অনেকেই এই ন্যক্কারজনক হামলার নিন্দা করেছিলেন।

বিএনপি সরকারের সময় এই গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। ক্ষমতাসীন বিএনপি এ মামলার তদন্তে একটি বিচার বিভাগীয় কমিটি গঠনসহ নানাভাবে তদন্তের ব্যবস্থা করে। সে সময় চার্জশিটও দেয়া হয়। ধরে নিলাম যেহেতু বিএনপি তদন্ত করে সেহেতু তারা তাদের কেউ জড়িত থাকলেও তার নাম জড়ায়নি। কিন্তু মইন উ ও ফখরুদ্দীনের যে তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এর পরে প্রতিষ্ঠিত হয়, তাদের মূল এজেন্ডাই তো ছিল জিয়া পরিবার, বিএনপি ও তারেক রহমানকে ধ্বংস করা। সেই হিংস্র এজেন্ডা বাস্তবায়নে ওই সরকারটি এই তিন স্তম্ভের বিরুদ্ধে করেনি এহেন কোনো অপকর্ম নেই। সেই সরকারও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ওপর নতুন করে তদন্ত করে ফের একটি চার্জশিট দায়ের করে। কিন্তু দেখার বিষয়, তারা শত চেষ্টা করেও সেই চার্জশিটে তারেক রহমানের নাম জড়াতে পারেনি। তাদের দেয়া চার্জশিটেও তারেক রহমানের নাম ছিল না।

চার.
কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ যেহেতু তারেক রহমান, সেহেতু তাকে না জড়ালে গায়ের জ্বালা মেটে কীভাবে। সে জন্য শুরু থেকেই আওয়ামী লীগের নানাস্তরের নেতা, পাতি নেতারা তারেক রহমান জড়িত বলে তারস্বরে চিত্কার শুরু করে।
স্বয়ং শেখ হাসিনা যখন সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী তখন থেকেই কোনো প্রমাণ ছাড়াই তদন্ত রিপোর্টগুলোকে পাশকাটিয়ে দাবি করেন, শুধু ২১ আগস্ট নয়, সব গ্রেনেড হামলা ও সন্ত্রাসের মূল হোতা তারেক রহমান।

ব্যক্তিগতভাবেও তারেক রহমান সম্পর্কে অনেক অশ্লীল ও শিষ্টাচারবর্জিত কটূক্তি করেছেন শেখ হাসিনা। জবাবে তারেক রহমান বিনয়ের সঙ্গে বলেছেন, তিনি আমার মাতৃস্থানীয়। তিনি যা বলছেন, তার দায়দায়িত্ব তার। কিন্তু আমি তার সম্পর্কে কোনো খারাপ কথা বলতে পারব না। এটা অশোভন হবে। এরপরও থামেনি শেখ হাসিনার অযৌক্তিক অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক, রুচিহীন বাক্য বর্ষণের ধারা। যা অদ্যাবধি তিনি সমানে চালিয়ে যাচ্ছেন।

সঙ্গত কারণেই ধারণা করা গিয়েছিল যেহেতু সততা, ন্যায়নীতি, আইন-কানুনের ধার এ সরকার ধারে না, সে জন্য তারা হয়তো তারেক রহমানের প্রতি তাদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য আবার একটি লোক দেখানো তদন্ত করে, নতুন করে চার্জশিট দেবে, হলোও তাই।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হয়েই চাকরি থেকে অবসরে যাওয়া সিআইডির এএসপি নিন্দিত ও বিতর্কিত আবদুল কাহার আখন্দকে পুলিশের প্রচলিত নীতি-নিয়ম ভেঙে ফের চাকরিতে ফিরিয়ে আনে। তার হাতে ন্যস্ত করে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার তদন্ত ও চার্জশিট দেয়ার ভার।

কাহার আখন্দ চাকরিজীবনে ছিলেন তুমুল বিতর্কিত। তাকে সবাই আওয়ামী লীগের একজন কঠোর মনোভাবাপন্ন কর্মী হিসেবে জানত। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে জাতীয় সংসদের সদস্য পদে নির্বাচন করার জন্য সব রকম প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। সে সময় তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়। তিনি তার স্বভাবসুলভ উগ্র ও নিষ্ঠুর আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটান কিশোরগঞ্জের নির্বাচনী এলাকায়। ২০০১ সালের ২৯ এপ্রিলের জনকণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তার সমর্থকরা অন্য একজন সম্ভাব্য প্রার্থীর (যিনি বিএনপি করতেন) সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। দুই পক্ষের মারামারিতে আহত হয় ৮ জন। পত্রিকায় শিরোনাম ছিল, ‘কিশোরগঞ্জে মেজর আখতার ও আবদুল কাহার সমর্থক সংঘর্ষ : আহত ৮।’

একই বছরের ১৪ মে তারিখে প্রকাশিত জনকণ্ঠের আরেকটি প্রতিবেদনে দেখা যায় কাহার আখন্দের সমর্থকরা আবারও প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। ১৬ মে তারিখে কাহার আখন্দের লোকজন প্রতিপক্ষের বাড়িঘর ভাঙচুর করে।
জনকণ্ঠকে সবাই জানেন আওয়ামী লীগের কড়া সমর্থক। সে জন্য জনকণ্ঠ থেকেই উদ্ধৃতি ব্যবহার করছি।
এই জনকণ্ঠে ৪ মে ২০০১ তারিখে এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, কিশোরগঞ্জ-২ আসনে (কটিয়াদি) কাহার আখন্দের মনোনয়ন প্রায় চূড়ান্ত করেছে আওয়ামী লীগ।
১ জুন তারিখে আবারও সংঘর্ষ হয়। এবার কাহার আখন্দের সমর্থকদের হাতে আহত হয় ২ শতাধিক মানুষ। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিয়ে কাহার আখন্দ সে সময় পোস্টার ছাপিয়ে নিজের নির্বাচনী প্রচারণাও চালিয়েছিলেন।

কাহার আখন্দ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচনে আওয়ামী প্যানেল থেকেও নির্বাচন করেন এর আগে। এরপরও সরকারি ভাষ্য মোতাবেক তিনি নিরপেক্ষ নির্দলীয় লোক! তাকেই আবার ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার তদন্ত ও চার্জশিট দেয়ার জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়।
শুধু তাই নয়, প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীকে অবাক করে দিয়ে তাকে এএসপি র্যাংক থেকে প্রমোশন দিয়ে এসপি পদে উন্নীত করা হয়। ঘটনা পর্যালোচনা করে এ কথা পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয় যে এএসপি পদে তাকে কারও না কারও তত্ত্বাবধানে কাজ করতে হবে। সেটা তার এসাইনমেন্ট বাস্তবায়নের পথে বাধা হতে পারে। এ কারণে তদন্তের সর্বময় কর্তা বানানোর জন্য কাহার আখন্দকে জবাবদিহিতা মুক্ত রাখার জন্যই এসপি পদে নিয়োগ দেয়া হয়।

এহেন কাহার আখন্দের কাছ থেকে কী রকম নিরপেক্ষ তদন্ত পাওয়া যাবে, তা বলাই বাহুল্য।
তারেক রহমানকে ফাঁসানোর সব নীল নকশা চূড়ান্ত করে এবার মাঠে নামেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম।

তাদের ভাষাও যদি ধরি, তাহলেও বলতে হবে, যে ঘটনা তদন্তাধীন, সেই বিষয় সম্পর্কে আগ বাড়িয়ে কথা বলা কখনোই সঙ্গত নয়। তারপরও পুলিশ, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা ও তদন্ত কমিটিকে প্রভাবিত করার জন্য আইন প্রতিমন্ত্রী ১৩ জুন নিউইয়র্কে ধুম করে ঘোষণা দিয়ে বসলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হবে। যে বিষয় তখনও তদন্তাধীন, সেই তদন্ত প্রতিবেদনে কে কে অভিযুক্ত হবেন, সে কথা তো কারোরই জানার কথা নয়। আইন প্রতিমন্ত্রী আগ বাড়িয়ে বলে বসলেন তারেক রহমানের নাম। এর অর্থ কী?
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ছাড়িয়ে গেলেন সবাইকে। তিনি ৫ জুলাই ২০১১ তারিখে ঘোষণা করলেন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মূল পরিকল্পনাকারী তারেক রহমান এবং এ সরকারের আমলেই গ্রেনেড হামলার রায় কার্যকর হবে।

ওপারে কাহার আখন্দ, এপারে সৈয়দ আশরাফ এবং কামরুলের মতো বাঁচাল লোকজন। ফলে গজব নেমে আসল মুফতি হান্নানের ওপর। মধ্যযুগীয় পৈশাচিক অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে ২০০ দিন রিমান্ডে নিয়ে অত্যাচার নির্যাতনের পাশাপাশি নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় করার চেষ্টা চলে। বলতে হবে তারেক রহমান গ্রেনেড হামলায় জড়িত। ০৭.০৪.২০১১ তারিখে ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ১৬৪ ধারায় তার কাছ থেকে আদায় করে তাদেরই রচিত জবানবন্দি। আওয়ামী মহল উল্লাসে ফেটে পড়ে। দেখ, এই যে তারেক রহমান এ হামলায় জড়িত।

কিন্তু ধর্মের কল নড়ে বাতাসে। ২৭.০৯.২০১১ তারিখে মুফতি আবদুল হান্নান তার আইনজীবীর মাধ্যমে ১৬৪ ধারায় রেকর্ডকৃত কথিত জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন করেন। সেখানে তিনি কী বলেছেন তার নিজের বক্তব্য থেকেই দেখা যাক : ‘এই মামলায় দ্বিতীয় জবানবন্দি রেকর্ড করার আগে অর্থাত্ ৪.৪.১১ তারিখ রাত আনুমানিক ১১টার দিকে কাশিমপুর কারাগার হইতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আমাকে নেওয়া হয়। জেলগেটে পৌঁছানোর পর সিনিয়র জেল সুপার তৌহিদুর রহমান লিখিত একটি কাগজে স্বাক্ষর করিতে বলিলে আমি অস্বীকার করায় আমাকে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করে বিষ প্রয়োগে হত্যার হুমকি দেয়। পরের দিন সকালে অর্থাত্ ০৫/৪/১১ ইং তারিখে ৬ সেল বনফুল ৬নং রুমে আমার অবস্থানে আনুমানিক সকাল ৭.৩০ মিনিটে সুপার ও তার সঙ্গে জেলার, ডেপুটি জেলার সেই কাগজটা দিয়ে স্বাক্ষর করতে বললে আমি আবারও অস্বীকার করি। ইহাতে সুপার গালাগাল দিয়ে হত্যার হুমকি দিয়ে চলে যায়।

ঐদিন সন্ধ্যায় অর্থাত্ ০৫/৪/১১ তারিখ সন্ধ্যায় ৬/৪/১১ তারিখে সিলেটে আমার কোর্ট থাকার দরুন চালান পাঠায়। সিলেটে কোর্ট শেষে আবার পরের দিন অর্থাত্ ০৭/৪/১১ ইং তারিখ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসে। সন্ধ্যায় জেলগেটে পৌঁছানোর সাথে সাথে জেলগেট থেকে সিআইডি ফজলুল কবীর ও আরো কয়েকজন সিআইডি অফিসার তাদের গাড়িতে করে ঢাকা কোর্টে নিয়ে আসে। সে সময় জেলের কোনো কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছিল না। কোর্টে পৌঁছিয়ে আমাকে কোর্টের একটি রুমে রাখে। যেখানে আইনজীবীরা বসে। পরে আমাকে ম্যাজিস্ট্রেট রুমে ফজলুল কবির নিয়ে যায়। আমি সেখানে ম্যাজিস্ট্রেটকে এখানে আনার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন যে, আপনার দরখাস্ত মোতাবেক ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় জবানবন্দি রেকর্ড করার জন্য এখানে আনা হয়েছে। শুনে আমি হকচকিত হয়ে বিচলিত হয়ে পড়ি। তখন ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে ফজলুল কবীর এবং পূর্বের ম্যাজিস্ট্রেটের রুমে বসে থাকা আব্দুল কাহার আকন্দ (সিআইডি) আমার হাতে একটি কাগজ দেয়, যেখানে বর্তমান আমার কথিত জবানবন্দিতে উল্লিখিত নাম—যেমন : তারেক জিয়া, হারিছ চৌধুরী, পিন্টু, বাবরসহ অনেকের নাম রয়েছে। আমি উক্ত রেকর্ডকৃত ও প্রস্তুতকৃত জবানবন্দিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করলে আমাকে জেলের ভেতরে হত্যা করাসহ রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করার হুমকি দেওয়া হয়।

রাত ১১টায় প্রায় এমন সময় ম্যাজিস্ট্রেট, আব্দুল কাহার আকন্দ ও ফজলুল কবীরের উপস্থিতিতে কয়েকটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর করতে বললে আমি সাদা কাগজে স্বাক্ষর করিনি। স্বাক্ষর না করার দরুন আমাকে পুলিশ দিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, আমাকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে উপস্থিত করার পূর্বে আমাকে বিভিন্ন মামলা দিয়ে রিমান্ডে নিয়ে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করত। ফজলুল কবীর ও আব্দুল কাহার আকন্দ মাঝেমধ্যে কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে র্যাবের নিকট নিয়ে যেত। র্যাব আমাকে নিয়ে শহরের বাহিরে নিয়ে যেত। আর বলত তুমি ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, আব্দুস সালাম পিন্টু, বাবর—এদের সঙ্গে হাওয়া ভবনে মিটিং করেছ, স্বীকার করতে হবে। আরও স্বীকার করতে হবে যে, বাবর ও আব্দুস সালাম পিন্টু গ্রেনেড ও টাকা দিয়েছে। তা নাহলে তোমাকে হত্যা করা হবে। এ পর্যন্ত গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে র্যাব, ডিজিএফআই ও সিআইডিসহ প্রায় ৪১০ দিন আমাকে রিমান্ডে নিয়ে অমানষিক নির্যাতন চালিয়েছে, ফলে আমার দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পেয়েছে, স্মৃতিশক্তিও হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে আমার ডান হাত ও ডান পা অবশ হয়ে গেছে। আমি ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার সাথে কোনোভাবেই জড়িত নই। আমি তারেক জিয়া, হারিছ চৌধুরী ও বাবরের সাথে হাওয়া ভবনে কোনো সময়ই দেখা করিনি। পিন্টু সাহেবের বাসায় কখনও যাইনি ও চিনি না। অন্যান্য আসামীদেরও আমি চিনি না। পূর্বেও কোনো পরিচয় ছিল না।

অদ্য ২৭/৯/১১ ইং তারিখ আদালতে উপস্থিত হয়ে নিয়োজিত আইনজীবীর মাধ্যমে আমার বক্তব্য লিখিয়ে পাঠ করত : সঠিক পেয়ে স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে অন্যের বিনা প্ররোচনায় অত্র প্রত্যাহারমূলক জবানবন্দির প্রতি পাতায় নিজ নাম স্বাক্ষর করিলাম। আব্দুল হান্নান।’

পাঁচ.
মুফতি আবদুল হান্নানকে ধন্যবাদ জানাই মৃত্যু ও নির্যাতনের মধ্যে থেকেও তিনি যে সাহস ও সততার পরিচয় দিয়েছেন তার জন্য। তার এই বক্তব্য একদিকে যেমন শাসকদের চরিত্র উন্মোচন করে দিয়েছে, তেমনি বহুদিন বহু নির্যাতিত মানুষকে সত্য বলার জন্য জোগাবে অনুপ্রেরণা। চিন্তাবিদ চার্লস ব্যাডেন যথার্থই বলেছিলেন, কোনো কারাবাসই কোনো সত্যকে ধ্বংস করতে পারে না। হয়তো সাময়িক বাধা সৃষ্টি করে মাত্র।
এ জন্যই জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম যথার্থই বলেছেন—

সত্য পথের তীর্থ পথিক! ভয় নাই নাহি ভয়,
শান্তি যাদের লক্ষ্য, তাদের নাই নাই পরাজয়।
অশান্তিকামী ছলনার রূপে জয় পায় মাঝে মাঝে
অবশেষে চির লাঞ্ছিত হয় অপমানে আর লাজে।

পথের ঊর্ধ্বে ওঠে ঝড়ো বায়ে পথের আবর্জনা
তাই বলে তারা ঊর্ধ্বে ওঠেছে কেহ কভু ভাবিও না!
ঊর্ধ্বে যাদের গতি, তাহাদেরই পথে হয় এরা বাধা,
পিচ্ছিল করে পথ, তাই বলে জয়ী হয় নাক কাদা।

অতএব দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী শক্তির ভয় নেই।
একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, তারেক রহমান দোষ-ত্রুটির ঊর্ধ্বের কোনো মানুষ নন। তাই বলে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতির মঞ্চের খলনায়কও নন। কিন্তু তাকে খলনায়ক বানানোর প্রাণান্ত প্রয়াস চারদিকে। যারা এই প্রয়াস চালাচ্ছে তারা আর যা-ই হোক বাংলাদেশের বন্ধু নন। বন্ধু নন বলেই তাদের রাজনৈতিকভাবে প্রতিহত করা জরুরি। এই কাজটি করতে পারলেই বাংলাদেশ অধীনতামুক্ত হবে। সেই কাজে অংশগ্রহণ করাই এ মুহূর্তের সবচেয়ে বড় দাবি। আশা করি, দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী শক্তি সময়ের এই আহ্বান শুনতে পাবেন।
[সূত্রঃ আমার দেশ, ২০/১১/১১]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন