রবিবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১৩

একটু লুকানোর জায়গা চাই -আনোয়ার জাহিদ

বিবর্তনবাদের জনক চার্লস ডারউইন বলেছিলেন, মানুষ এককালে বাঁদর ছিল এবং বর্তমান আধুনিক মানুষ বাঁদরেরই গোত্রভুক্ত প্রাণী। ডারউইনের পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথা আছে। বর্তমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে সে ব্যাপারে আলোচনা করা নিতান্ত আহম্মকি ছাড়া আর কিছুই নয়। অবশ্য এতটুকু বলা যেতেই পারে যে, মানুষ বাঁদরের গোত্রভুক্ত হলেও হতে পারে; তবে বাঁদরের বাঁদরামি যদি কমে তাহলে তা স্বস্তিকর। অপরপক্ষে মানুষের মনুষ্যত্ব যদি কমে তাহলে তা শুধু অস্বস্তিকরই নয়, ধ্বংসাত্মকও বটে।

আমরা বাঁদর নই। মানুষ। আমাদের ভাষা আছে। নিজ নিজ ধর্ম আছে। গোত্র আছে। সমাজ আছে। রাষ্ট্র আছে। আর রাষ্ট্র যেহেতু আছে, রাষ্ট্রপতিও আছেন। আমাদের দেশের প্রচলিত শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। সর্বাধিক সম্মান পাওয়ার অধিকার তার। তিনি মহামান্য।
বাংলাদেশের বয়স ৪১ বছর। এযাবতকালে রাষ্ট্রপতি হয়েছেন ১৯ জন। বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতির পেছনের ইতিহাস বা যিনি রাষ্ট্রপতি হলেন তিনি কোন প্রক্রিয়ায় হলেন এটা বিবেচ্য বিষয় নয়। যিনি রাষ্ট্রপতি তিনি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রধান। বিশেষত রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সবকিছুতেই তার সর্বাধিক কর্তৃত্ব। কিছু বিষয় রাষ্ট্রপতি নিজে নিয়ন্ত্রণ করেন। কিছু বিষয় রাষ্ট্রপতির নামে পদস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিয়ন্ত্রণ করেন। এখানে উল্লেখ্য এই যে বর্তমানে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা রাষ্ট্রপতিকে ঢাল এবং তলোয়ার উভয়রূপে ব্যবহার করে থাকেন।
বাংলাদেশের ৪১ বছরের ইতিহাসে বর্তমান রাষ্ট্রপতি যতটা আলোচিত, এর আগে কোনো রাষ্ট্রপতি এতটা আলোচিত হননি। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মাফ করে দেয়ার ক্ষেত্রে সামরিক অভ্যুত্থান করে ক্ষমতায় আসা অনেক বাঘা বাঘা রাষ্ট্রপতিকে পরাজিত করেছেন তিনি। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছেন। লাশ টুকরো টুকরো করে নদীতে ফেলে দেয়া দাগি আসামিরাও তার দয়ালাভে সমর্থ হয়েছে। আশা করি ভবিষ্যতেও হবে। এখানে একটু বলে রাখি, রাষ্ট্রপতি মহোদয়ের এই দয়া করা বা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করার যে ক্ষমতা তা ভবিষ্যতেও বহাল থাকুক, এটা আমার প্রাণের দাবি। কারণ এই ক্ষমতা আজ অনেক পরিবারের কান্না থামানোর একমাত্র অন্তরায়। আর এই কান্না দিন দিন বাড়ছে। যার দয়ার জন্য পরিবারে পরিবারে শোকের মাতম, ‘শোক’ তাকে স্পর্শ করবে না তা কি হয়? যে দুঃখ দেয় তারও তো দুঃখ পাওয়ার দরকার আছে। আজ মহামান্য রাষ্ট্রপতি ৫ জনকে প্রাণভিক্ষা দিতেই পারেন। আগামী রাষ্ট্রপতি হয়ত ১০ জনকে দেবেন। তার মধ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার আসামিরাও থাকতে পারেন। আজ এ বিষয়ে সাধারণের কথা বলার অধিকার নেই। সেদিনও থাকবে না।
অধিকারের প্রসঙ্গ যখন এলোই তখন একটু কথা বলি। আজ যখনই রাষ্ট্রপতি প্রসঙ্গে কথা হয় তখনই বিভিন্ন মন্ত্রী বলেন, রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তের ব্যাপারে মন্তব্য করার অধিকার কারও নেই। তাদের কাছে আমার বিনীত নিবেদন—‘ইয়েস উদ্দিন, নো উদ্দিন’ শব্দগুলো কোথা থেকে এসেছে? এরশাদবিরোধী আন্দোলন যখন চলছিল তখন তো এরশাদ সাহেব রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তাহলে আপনারা যারা সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হবে না? বাস্তব কথা হলো, অধিকার-অনধিকার, বৈধ-অবৈধ শব্দগুলো দিয়ে জনদাবিকে অস্বীকার করা যায় না। এগুলো ক্ষমতা প্রদর্শনের ব্যাকরণ মাত্র। বাঘের শরীরে যেমন একটা বুনো সৌন্দর্য প্রতিভাত হয়, তেমনি সরকারের মন্ত্রীরা বা পুলিশ বাহিনী নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে এসব শব্দকে সুগন্ধি হিসেবে ব্যবহার করে থাকে।
পুলিশ অফিসার হারুন সাহেব সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি পদক পেয়েছেন। এতে করে জাতি সত্যিকার অর্থেই দায়মুক্ত হলো! যে জাতি তার বীরদের সম্মান জানাতে পারে না, সে তো নিকৃষ্ট! হারুন সাহেব ঈমানদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি আজ বিশ্বের সব পুলিশ সদস্যের আদর্শ। মহামান্য ‘রাষ্ট্রপতি পদক’ তার হাতেই শোভা পায়। রাষ্ট্রপতি পদক যুগ যুগ বেঁচে থাক। শুধু এটুকুই বলব, আগামী দিনেও মানিক মিয়া এভিনিউতে একই ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। সেদিন যেন সেই পুলিশ সদস্যকেও রাষ্ট্রপতি পদক দেয়া হয়। এক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক স্লোগান খুবই প্রাসঙ্গিক। ‘কেউ পাবে আর কেউ পাবে না, তা হবে না, তা হবে না।’
আমি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বা মাহমুদুর রহমান নই। সত্য কথা হলেই সেটা বুক উঁচু করে বলতে পারি না। শুধু এতটুকু মিনতি, এতটুকু প্রার্থনা, এতটুকু অনুরোধ মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে—যে মা সন্তানের দেয়া আঁচড় দেখে স্বামীর লাশ শনাক্ত করেছে সেই মায়ের দিকে একটু দয়ার দৃষ্টিতে তাকান। পুলিশের মারমুখী ভূমিকা বন্ধ করার দরকার নেই। অন্তত একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ হিসেবে তাদের বিকৃত তত্পরতাকে সমর্থন করবেন না। আর যদি সবকিছুই রাজনৈতিক বিবেচনায় চলমান রাখেন, তাহলে করজোড়ে মিনতি, একটু লুকানোর জায়গা দিন। এমন জায়গায় লুকাতে চাই, যেখানে বিধবা নারীর কান্না পৌঁছবে না। খুনির বিজয় উল্লাস পৌঁছবে না। পদক, মেডেল, ক্রেস্টের দরকার নেই। নগ্নতা চাই না। একটু আড়াল চাই। একটু লুকোতে চাই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন