ডঃ শহীদ শামসুজ্জোহা (১৯৩৪-১৯৬৯) ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়-এর
রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক (তৎকালীন রিডার)। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের
সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের দায়িত্ব পালনকালে ১৯৬৯ সালের ১৮ই
ফেব্রুয়ারী তাঁকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নির্মভাবে হত্যা করে।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-এ তিনটি মৃত্যু দেশের আপামর জনতাকে পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি ছাত্রনেতা আমানুল্লাহ আসাদুজ্জামান, ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হক এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক ডঃ শহীদ শামসুজ্জোহার মৃত্যু দেশেবাসীকে স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে ধাবিত করে। ডঃ মুহম্মদ শামসুজ্জোহাকে দেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবি হিসেবে গন্য করা হয়। ভাষা আন্দোলনের সময়ও তিনি প্রত্যক্ষভাবে আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন।
জন্ম ও শিক্ষা
সৈয়দ মুহম্মদ শামসুজ্জোহার জন্ম ১লা মে, ১৯৩৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ-এর
বাঁকুড়া জেলায়। পিতা মুহম্মদ আব্দুর রশীদ ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের
নিম্নবেতনভোগী চাকুরে। পিতা,মাতা, তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে প্রফেসর জোহা
ছিলেন দ্বিতীয়। জোহার প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয় পশ্চিমবঙ্গেই। বাঁকুড়া
জেলা স্কুল থেকে তিনি ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করে
কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় প্রথম শ্রেনীতে উত্তীর্ন হন।
বাঁকুড়া ক্রিশ্চিয়ান কলেজে দুবছর পড়াশোনার পর ১৯৫০ সনে প্রথম শ্রেনীতে
ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। দেশবিভাগের পর ১৯৫০ সালের প্রথমদিকে পূর্ব ও
পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে জোহা তাঁর পরিবারবর্গকে নিয়ে
পূর্ববাংলায় চলে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নে স্নাতক সম্মান
শ্রেনীতে ভর্তি হন। এসময় ভাষা আন্দোলন-এর
সাথে তিনি প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েন। আর্থিক কষ্ট ও পারিবারিক বিপর্যয়
সত্বেও তিনি ১৯৫৩ সালে স্নাতক সম্মান পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেনীতে
উত্তীর্ন হন এবং স্বনামধন্য রসায়নবিদ ড.মোকাররম হোসেন খন্দকারের
তত্ত্বাবধানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রীর জন্য গবেষণা শুরু করেন। গবেষণার বিষয়
ছিলো “বৈদ্যুতিক পদ্ধতিতে ক্রোমাইট খনিজের জারণ প্রকৃয়া”, যেটি
পরবর্তীকালে ১৯৫৪ সালে লন্ডনের “রসায়ন শিল্প” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
১৯৫৪ সালে জোহা কৃতিত্বের সাথে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন।
পরিবার
প্রফেসর জোহা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালে নিলুফার ইয়াসমিনের
সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। নিলুফার ইয়াসমিন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু
শিক্ষা কেন্দ্রের একজন শিক্ষয়িত্রী। ১৯৬৬ সালে জোহা দম্পতি একটি
কন্যাসন্তান লাভ করেন।
পেশাগত জীবন
১৯৫৫ সালের শেষের দিকে জোহা বেকারত্ব ঘুচিয়ে “পাকিস্তান অর্ডন্যান্স
কারখানায়” সহযোগী কারখানা পরিচালক হিসেবে নির্বাচিত হন। ওই বছরেরই ১৪ই
ডিসেম্বর তিনি
গ্রেট বৃটেনের সাউথ ওয়েলসে রয়্যাল অর্ডিনেন্স কারখানায় বিষ্ফোরক দ্রব্যের উপর প্রশিক্ষন লাভের জন্য যোগদান করেন। ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত তিনি
Imperial College of Science & Technology, London এ পড়াশোনা করেন এবং
লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়
হতে বিএসসি ডিগ্রী লাভ করেন। পরে ১৯৫৯ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে ওয়াহ
ক্যান্টনমেন্টে সহকারী পরিচালক পদে যোগদান করেন। ১৯৬১ সালে অর্ডন্যান্স
কারখানায় ইস্তফা দিয়ে জোহা উপস্থিত হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়এ।
প্রভাষক হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালে তিনি স্কলারশীপ
নিয়ে পুনরায় লন্ডন ইম্পেরিয়াল কলেজে গমন করেন। পিএইচডি ও ডিআইসি
ডিগ্রীলাভ করে তিনি ১৯৬৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন। ডিগ্রী লাভকালে
তিনি কিছুকাল বেরেট স্ট্রীট ওয়েস্ট লন্ডন কমার্স কলেজে শিক্ষকতা করেন।
এরপর তিনি স্থায়ীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে থাকেন। ১৯৬৮ সালে
নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক বছর মেয়াদী স্কলারশীপ পেলেও
বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ছাড়েনি অভিজ্ঞ শিক্ষকের অভাবে। পরবর্তীতে তিনি
কিছুকাল বিশ্ববিদ্যালয় শাহ মখদুম হলের হাউস টিউটরের দায়িত্ব পালন করেন
এবং ১৯৬৮ সালের উত্তাল সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর কাধে তুলে দেয় প্রক্টরের
সুবিশাল ও মহান দায়িত্ব।
গণ-অভ্যুত্থান ও প্রফেসর জোহা
১৯৫২ সালের পর থেকে স্বাধীনতা অর্জন করা পর্যন্ত তৎকালীন
পূর্ববঙ্গ/পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশ প্রতিদিন কোনো না কোনো
আন্দোলনের ভেতর দিয়ে সময় অতিক্রম করেছে। ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানের
মানুষেরা ১৯৬৬-এর ছয় দফা ও ১১ দফার দাবিতে এবং বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আনিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলে। ২০ জানুয়ারি পাকিস্তানি পুলিশের গুলিতে মিছিল করা অবস্থায় ছাত্র ইউনিয়ন-এর নেতা আমানুল্লাহ আসাদুজ্জামান শহীদ হন। ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সেনানিবাসে আগরতলা ষড়যন্ত্রমূলক মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে
মেরে ফেলা হয়। এই দুটি মৃত্যুতে আন্দোলন আরও বেগবান হয়ে ওঠে। উদ্ভূত
পরিস্থিতি প্রাদেশিক সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। কেন্দ্রীয়
সরকার সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। সান্ধ্যকালীন আইন
জারি করা হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা
ভঙ্গ করে মিছিল করার চেষ্টা করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর
ভাষাসৈনিক শামসুজ্জোহা স্পষ্টতই দেখতে পান আন্দোলনকারী ছাত্ররা মিছিল বের
করলে অনেক ছাত্রের জীবননাশের আশঙ্কা রয়েছে। তিনি নিজের জীবন বাজি রেখে
ছাত্রদের সামনে গিয়ে দাঁড়ান। সামনেই ছিল সেনাসদস্যরা। শামসুজ্জোহা নিজের
পরিচয় দিয়েছিলেন সেনাসদস্যদের। কিন্তু সেনাসদস্যরা তাঁর সব কথা উপেক্ষা
করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
শামসুজ্জোহা বলেছিলেন যদি সেনাবাহিনী গুলি করে, তাহলে তাঁর সামনে তিনিই
প্রথমে দাঁড়াবেন। তাঁর কথাই সত্যি হয়েছে। এই খবর ঢাকায় পৌঁছামাত্র ঢাকার
রাজপথ আন্দোলনকারীরা প্রকম্পিত করে তোলে। পরবর্তী আন্দোলনের মাত্রা এতটাই
দুর্দমনীয় ছিল যে, নিঃশর্তভাবে বঙ্গবন্ধু-কে
ছেড়ে দিতে পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয় এবং জেল থেকে মুক্তি পেয়েই তিনি
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার সঙ্গে একমত পোষণ করেন। এভাবেই গণমানুষের
স্বাধিকারের সংগ্রাম স্বাধীনতার দিকে ধাবিত হয়।
মৃত্যু-পরবর্তী চেতনা
জোহার মৃত্যু সমগ্র দেশ তথা পাকিস্তান সরকারের ভীত নাড়িয়ে দিয়েছিলো।
এর প্রভাব ছিলো সূদূরপ্রসারী, যা দেশকে স্বাধীন করতে অন্যতম ভূমিকা পালন
করেছিলো। দেশ স্বাধীনের পর জাতি তাঁর অবদানকে কৃতজ্ঞ চিত্তে স্বরন করে তাকে
শহীদ বুদ্ধিজীবির সম্মানে ভূষিত করে। তাঁর প্রিয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
এখনো তাঁর স্মৃতি লালন করে চলে। তাঁর মৃত্যুর পরপরই তৎকালীন
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁর নামানুসারে নবনির্মিত আবাসিক হলের নামকরন করেন
শহীদ শামসুজ্জোহা হল। নাটোরে তাঁর নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
এছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ প্রতিবছর ‘জোহা সিম্পজিয়াম’
পালন করে। সম্প্রতি দেশের শিক্ষকসমাজ জোহার মৃত্যুদিবসকে ‘জাতীয় শিক্ষক
দিবস’ হিসেবে পালনের দাবী জানিয়ে আসছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন